ভারতে বাংলা ভাষা কি কারণে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলছে এবং এর ফলে ভবিষ্যতে কি হতে পারে?
![]() |
| বাংলা ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে সুমিষ্ট ভাষাগুলির মধে অন্যতম |
সম্পাদকীয় প্রবন্ধঃ ডিজিটাল ডেস্ক শিলিগুড়ি, জুলাই ১৩, ২০২৫
আর অন্য ছুটির দিনের মত এবারও রবিবারে ভাতঘুম দিতে গিয়েও থমকে গেলাম। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা ভাতঘুমকে জীবনে উন্নতির পথে প্রধান বলে উপদেশ দিয়েছেন। এবং যুগ যুগ ধরে এরকম অনেক উপদেশ দেওয়া-নেওয়ার অভ্যাস আমাদের বংশগতির ধারক এবং বাহক ডিএনের মধে নিশ্চয়ই কোডিং করা আছে। তাই ভাতঘুমকে জব্দ করতে স্মার্ট টিভি খুললাম। আজকাল নতুন প্রজন্ম টিভি খুব একটা দেখে না। কিন্তু আমাদের মিলিনিয়াল প্রজন্ম টিভি দেখে বড় হয়েছে, তাই টিভির প্রতি এখনো আমাদের একটা টান রয়ে গেছে যেমন আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মদের রেডিওর প্রতি টান ছিলো। সময় বদলায়, যুগ বদলায় এবং চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন সংসারের নিয়ম এবং এই সত্যটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
কিন্তু সবচেয়ে বেদনাদায়ক হয় যখন একটি ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা বদলে যায়। ভাষা বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিক পরিচয়গুলি ধীরে ধীরে হারাতে শুরু করে। সেই গোষ্ঠীর লোকজন অন্য গোষ্ঠীর ভাষা শেখার সঙ্গে সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকেও নিজের সংস্কৃতি মেনে নিতে শুরু করে। ভাষা বদলের কারণে এরকম বহু গোষ্ঠীর ধীরে ধীরে কখন অবলুপ্ত হয়েছে তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। আর যখন পেরেছে তখন আর তাদের আর কিছুই করার ছিলো না।
এখনই বিষয় আলোচনাতে ওঠে যে একটি বৃহৎ দেশে বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর জনগণ অবশ্যই থাকবে। তাদের মধ্যে ভাষা সংস্কৃতির অবশ্যই পার্থক্য থাকবে। কিন্তু বিভিন্ন ভাষা গোষ্ঠির মধ্যে অবশ্যই ভাষা সংস্কৃতি, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক মতামতের আদান প্রদান হবে। এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই তো ঐক্য। কিন্তু বর্তমানে দেশ, বিদেশ, মহাদেশ এবং পৃথিবীর পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে একটা প্রশ্নই আমার মনে হয় সত্যিই কি ভাষা সংস্কৃতির আদান প্রদান হচ্ছে? না সবলরা দূর্বলদের ওপরে জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে।
এখানে সবল বলতে বোঝানো হচ্ছে যে ভাষাগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বেশী, রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বেশী, অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী , যে ভাষাগোষ্ঠীর কাছে আধুনিক প্রযুক্তির চাবিকাঠিগুলো আছে। এখন আপনি নিজে বিবেচনা করে দেখুন যে আপনার নিজের ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে ওই চারটি গুণাবলী আছে কি না। যদি না থাকে তাহলে নিজের ভাষাগোষ্ঠীর জন্য এখন থেকে চেষ্টা করুন ওই চারটি গুণাবলীর মধ্যে অন্তত দুইটি গুণাবলী আয়ত্ব করতে। নিজের পরবর্তী প্রজন্মদের ওই চার গুণাবলী অর্জন করার জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করুন। আপনার নিজের সংস্কৃতির ভালো দিকগুলোর সঙ্গে আপনার পরবর্তী প্রজন্মকে পরিচিত করান। এবং অন্য ভাষাগোষ্ঠীকে সন্মান এবং তাদের কাছ থেকে ভালো গুণাবলী আয়ত্ব করুন। আজ পৃথিবীর উন্নত ভাষাগোষ্ঠীর দিকে লক্ষ্য করলে বুঝতে পারবেন তারা ধৈর্য্য ধরে এই পথেই এগিয়ে চলছে।
ফিরে আসি এবার সেই টিভির কথায়। তো দুপুরে টিভি দেখতে গিয়ে কয়েকটি জনপ্রিয় ওটিটি অ্যাপ-এ ওয়েব সিরিজ এবং সিনেমার প্রিভিউ দেখে মনে হলো এখানে বুঝি বাংলার সংস্কৃতির ওপরে ভিত্তি করে বানানো হয়েছে। কিন্তু সেগুলো চালাতে গিয়ে হতাশ হলাম কারণ স্ট্রিমিং অডিওতে বাংলা ভাষা খুঁজে পেলাম না। অন্য ভাষায় সেই ভিডিও চালাতে গিয়েও হোঁচট খেলাম। এতবছর ধরে যাদের মুখে বাংলা ভাষায় সংলাপ শুনে বড় হলাম, তাদের মুখে অন্য ভাষায় সংলাপ যেন মন থেকে নিতে পারছিলাম না। ঠিক যেরকম আমি বলিউডের কোনো জনপ্রিয় অভিনেতার হিন্দি সিনেমা অন্য ভাষায় দেখে সন্তুষ্ট হতে পারবো না।
সেদিন শহরের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক বলছিলেন যে “আমাদের সমাজে বাংলা ভাষার চাহিদা কমে যাচ্ছে কেন জানেন? কারণ এই ভাষার ব্রান্ডভ্যলু আমরা তৈরী করতে পারিনি। আর চাহিদা তৈরী হবেই বা কি করে বলুন। এখন এমন কয়টা সরকারি বা বেসরকারি চাকরির বিজ্ঞাপন দেখছেন যেখানে বাংলা ভাষায় দক্ষতা থাকা বাধ্যতামূলক। স্কুলের মিটিংয়ে অভিভাবকরাই মাতৃভাষার বদলে অন্য ভাষা শেখানোর জন্য জোর দিতে বলেন। ফলে আমরাও বাধ্য হই। আর ওই যে সংস্কৃতির কথা বললেন হ্যাঁ এখনো স্কুলের অনুষ্ঠানে বাংলায় গান, নাচ করা হয়। কিন্তু এটাও আগামীদিনে টিকে থাকবে কিনা বলা মুশকিল।“
শহরের এক প্রবীণ বুদ্ধিজীবি কথা প্রসঙ্গে বললেন “দেখুন কোনো দেশের একটি ভাষাগোষ্ঠির বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া বিপদজনক। বিশেষ করে সেই ভাষা যদি অন্য একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা হয়। এই ভাষার কারণেই, দুটো দেশের মধ্যে যতই শত্রুতা থাকুক না কেন তারা একে অপরের প্রতি আগ্রহ কোনোভাবেই হারাতে পারেনা। এর সবথেকে বড় প্রভাব দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফলে একটি বড় দেশের মধ্যে এইরকম একটি ভাষা গোষ্ঠীর বিল্পুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া বিপদজনক হতে পারে। রাষ্ট্র দ্বারা স্বীকৃত এরকম একাধিক ভাষা আছে যেগুলি অন্য রাষ্ট্রেও প্রচলিত আছে। এবং এই ভাষার মাধ্যমেই সেই সব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে। সুতরাং প্রতিটি ভাষা এবং ভাষাগোষ্ঠীর উন্নতির সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নতি প্রত্যেক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকে।“
বাংলা বাদে পৃথিবীতে এরকম বহু ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি চর্চা এবং চাহিদার অভাবে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়েছে অথবা অবলুপ্তির পথে এগিয়ে চলছে। একবার এক দার্শনিকের কাছে শুনেছিলাম “কোনো ভাষা মানুষ শিখে দুইটি কারণে এক ভালোবেসে অথবা দুই জীবিকার তাগিদে। আপনি আপনার মাতৃভাষার জন্য কোন কারণটি সৃষ্টি করতে পেরেছেন?"
.jpg)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন